We're glad you visited this site! 😊 OK

রূপকথার গল্প যখন ঘুমালো

ব্রিটেনের রানী যেদিন মারা গেলেন, একটা স্ট্যাটাস দেখে চমকে উঠলাম। জীবনে দুটি জিনিসের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করে দিয়ে গেছেন নানী, মুড়ি আর রূপকথার গল্প।
রূপকথার গল্প যখন ঘুমালো - সিমু নাসের - অনুলিখন

ব্রিটেনের রানী যেদিন মারা গেলেন সেদিন একটা স্ট্যাটাস দেখে বেশ চমকে উঠলাম। একজন লিখেছেন, ইংল্যান্ডের রানী মারা গেছে কিন্তু মানুষের এমন ভাব করছে যেন তার নানী মারা গেছে। চমকে উঠার কারন হলো, সেদিন সত্যি সত্যি আমার নানী মারা গেছেন। আমার প্রিয় নানী মারা গেছেন।

আমার জীবনে দুটি জিনিসের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করে দিয়ে গেছেন নানী। এক মুড়ি,  দুই রূপকথার গল্প।

আমার দাদাবাড়ি থেকে নানাবাড়ির দূরত্ব সেই আমলে ছিলো প্রায় ২৩ ঘন্টা। ইন্টারসিটি ট্রেন তখনো আমাদের রুটে চালু হয়নি। বছরে একবার করে একমাসের জন্য যেতাম ট্রেন, স্টিমার বাহাদুরাবাদ ঘাট হয়ে নানাবাড়ি। সন্ধ্যা ৭/৮টায় আব্বা-আম্মার সাথে এইট ডাউন/সেভেন আপ/উত্তরবঙ্গ মেইলে চড়ে গভীর রাতে পৌঁছাতাম ঘাটে। রেলগাড়ি যেখানে থামতো সেখান থেকে বেশ খানিকটা হেঁটে চড়তে হতো স্টিমারে। স্টিমারে যাওয়ার পথেই ঘাটের সারি সারি খাবারের দোকানে বসে পড়তাম রাতের খাবার খেতে। সবচেয়ে ভালো লাগতো তখন নদীর নানা রকমের মাছ আর লাল ঝোলের ডিমওয়ালা তরকারি দিয়ে গরম ভাত।

এরপর অসহনীয় ৩/৪ ঘন্টার স্টিমার যাত্রা। বেশিরভাগ সময়ই স্টিমার থাকতো ভয়ংকর নোংরা। আমি স্টিমারের অর্ধস্বচ্ছ কাঁচের ভেতর দিয়ে অপর দিকের ঘাটের সারি সারি হলুদ বাল্ব দেখার অপেক্ষায় থাকতাম। কখন আসবে ঘাট! কখন শেষ হবে এই যমুনা নদী। এরপর আবার লম্বা ট্রেনযাত্রা। তর সইতো না নানীর মুড়ি মাখা আর রাতের 'কিস্তা' শোনার।

মুড়ির প্রতি আমার এত ভালোবাসা কেন জন্মেছে এর গোড়ার কারন আমার নিজেরও মনে নাই। কিন্তু মনে আছে নানী আমার আগমন উপলক্ষে একদম টায়ে টায়ে দুই বস্তা মুড়ি ভেজে আলাদা করে রাখতেন। সেটায় আর কাউকে হাত দিতে দিতেন না। আমি সকাল বিকাল সন্ধ্যা যখনই সময় পেতাম বাটিতে করে মুড়ি খেতাম। কখনও পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে, কখনও গুড় দিয়ে, কখনও নারকেল কুড়ানি দিয়ে, কখনও কখনও এমনি এমনিই। দুই বস্তা মুড়ি আমি শেষ করতাম একমাসে। কখনো কখনো খালি মুড়ি খেয়ে মুখ ছিলিয়ে ফেলতাম কিন্তু আমি মুড়ি খাওয়া থামাতাম না। এখনও মুড়ি আমার খুব প্রিয়। ভরা পেটেও যতক্ষন ইচ্ছা ততক্ষন মুড়ি খেতে পারি। দুই বস্তা মুড়ি শেষে হলে উনি আরেকটা গোপন জায়গা থেকে আরও কিছু মুড়ি বের করে আবার তিনি সাথে করে দিয়েও দিতেন যেন যাত্রাপথে খেতে পারি। কী যে আদর করতেন আমাকে!

আর বানাতেন একটা অদ্ভুত পিঠা। উনি বলতেন, বকুনি পিঠা। রেসিপিটা এমন, একটা বিশেষ ধরনের ধান পানিতে ভিজিয়ে রাখার পর সেগুলোয় চারা গজাতো। এরপর সেটা শুকিয়ে চাল বানানো হতো। সেটা দিয়ে ভাত রান্না করে আরও কী কী জানি দিয়ে রাতে ভিজিয়ে সকালবেলা খাওয়া। খাওয়ার পর সারাদিন ঘুমঘুম যে ভাবটা থাকতো সেটা এখনো মনে আছে। এই পিঠা আমি আর কোথাও কখনো খাইনি একমাত্র নানীর হাতে ছাড়া। কিছুদিন আগে আমি বলেছিলাম, ও নানী ওই পিঠাটা খাওয়ান না। কিন্তু উনার শরীরে আর সেই শক্তি ছিলো না। তবুও বলেছিলেন, নানীবাড়ি গেলে খাওয়াবেন।

আমি ছিলাম নানীর বড় নাতী। সন্ধ্যা হলেই রাতের খাবার খেয়ে তার পাশে শুয়ে পড়তাম গল্প শুনতে। নানী সেগুলোকে বলত 'কিস্তা'। তখনই বুঝতাম কিচ্ছা-কাহিনীই আসলে কিস্তা। কিন্তু কিস্তা শোনার মূল প্রতিবন্ধক ছিলো নানীর ঘুম। কত কত যে গল্প। কোনোটাই নানী ঘুমের কারনে একদিনে শেষ করতে পারতেন না। আমি একটু পর পর বলতাম, এরপর...এরপর! উনি আবার গল্প শুরু না করলে বুঝতাম উনি ঘুমিয়ে গেছেন। তখন গায়ে ধাক্কা দিয়ে আবার শুরু করতাম ঘ্যান ঘ্যান...এরপর? কোনো কোনো গল্প শেষ হতে তিনচারদিনও লাগতো। বেশিরভাগ গল্পেই থাকতো রাজকুমারী, তার লম্বা চুল, কৌটার মধ্যে আটকে পড়া রাজপুত্রের প্রাণভোমরা। কোটালপুত্রের ষড়যন্ত্র। লম্বা জোব্বাধারী আগন্তুকের দিনের পর দিন বন-বাদাড়, জঙ্গল পেড়িয়ে হেঁটে চলা।

সর্বশেষ ঢাকায় আমার বাসায় যে কদিন তিনি ছিলেন আমি রাতের বেলা বাসায় ফিরে নানীকে বলতাম, নানী কিস্তা শোনান। নানী কপট বিরক্তি নিয়ে বলত, ধুরো আমার কি আর এগলা মনে আছে? কিছুই মনে থাকে না।

নানী মারা যাওয়ার পর থেকে প্রতিরাতেই নানীর পরিস্কার সুন্দর মুখটা ভেসে উঠে। আমি বলি, ও নানী ঘুমাইলেন, এরপর কি বলেন না...কোটালপুত্রের এরপর কী হলো? উনি কোনো জবাব দেন না...ঘুমিয়ে পড়েছেন আবারও।


লেখকঃ সিমু নাসের, পলিটিক্যাল স্যাটারিস্ট।

(লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.